এক সময় বোরো ফসলের অফুরন্ত ভান্ডার হিসেবে পরিচিত কিশোরগঞ্জ জেলার হাওরাঞ্চলে ধান কাটার মৌসুমে স্থানীয়সহ দেশের নানা অঞ্চল থেকে লাখো কৃষিশ্রমিকের আগমন ঘটতো। তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এই চিত্রে এসেছে দৃশ্যমান পরিবর্তন। বর্তমানে ধান কাটার মৌসুমেও শ্রমিক সংকট প্রকট হয়ে উঠেছে।
স্থানীয় কৃষকদের অভিযোগ, বৈশাখের প্রখর রোদ, হাওরের ঝড়-বৃষ্টি এবং ন্যায্য মজুরি না পাওয়ায় অনেক কৃষিশ্রমিক এই পেশা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন। কেউ কেউ প্রবাসে পাড়ি দিচ্ছেন, কেউ বা যোগ দিচ্ছেন গার্মেন্টস, নির্মাণ বা অন্যান্য কর্মক্ষেত্রে। এছাড়াও কৃষিতে যান্ত্রিকীকরণের ফলে শ্রমিকের চাহিদাও কমে গেছে।
মিঠামইন হাওরের কৃষক মারুফ মিয়া জানান, আগের মতো সহজে শ্রমিক পাওয়া যায় না। দিন দিন শ্রমিকের সংখ্যা কমে যাচ্ছে। কটিয়াদী উপজেলার করগাঁও এলাকার কৃষক আশরাফুল ইসলাম বলেন, আগে বোরো মৌসুমে করগাঁও স্কুল মাঠে কৃষিশ্রমিকের হাট বসতো, যেখানে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে হাজার হাজার শ্রমিক আসতেন। এখন সেই হাটও আর বসে না।
নিকলী হাওরের কৃষক মকবুল হোসেন বলেন, “১ একর জমির ধান শ্রমিক দিয়ে কাটতে সময় লাগতো ৫-৬ ঘণ্টা, এখন কম্বাইন্ড হারভেস্টারে লাগে মাত্র ১ ঘণ্টা।” এই যান্ত্রিকীকরণের প্রভাবেই শ্রমিকের চাহিদা কমে যাচ্ছে।
ষাটোর্ধ্ব রুহুল আমিন, যিনি ৩০ বছর ধরে কিশোরগঞ্জে ধান কাটতে আসেন, জানান, “আগে আমাদের দলে ৬০-৬৫ জন শ্রমিক থাকতো, এখন মাত্র ১৬ জন। অনেকে বিদেশে চলে গেছে, অনেকেই পেশা বদলেছে।”
শুধু অর্থনৈতিক কারণে নয়, সামাজিক মর্যাদা, নিরাপত্তাহীনতা এবং শিক্ষা বৃদ্ধির প্রভাবেও কৃষিশ্রমিকের সংখ্যা কমছে। মনিরুজ্জামান নামের এক শ্রমিক জানান, হাওরে বজ্রপাত বেড়ে যাওয়ায় শ্রমিকরা ভয় পাচ্ছেন। নুরুল ইসলাম বলেন, “আমাদের সন্তানরা শিক্ষিত হচ্ছে, তারা আর এই পেশায় আসতে চায় না।”
অষ্টগ্রাম সদর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান সৈয়দ ফাইয়াজ হাসান বাবু বলেন, “বর্তমান প্রজন্ম কৃষিকাজকে সম্মানজনক পেশা মনে করে না। তারা চাকরি, ব্যবসা বা বিদেশে যাওয়ার দিকেই ঝুঁকছে।”
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রযুক্তির ব্যবহার, শহরমুখী প্রবণতা এবং শ্রমের অবমূল্যায়নের ফলে দিন দিন কৃষিশ্রমিক সংকট বাড়ছে। এর ফলে ধান কাটা ব্যাহত হচ্ছে এবং কৃষকরা ক্ষতির মুখে পড়ছেন।
বাংলাদেশ শ্রমিক কল্যাণ ফেডারেশন কিশোরগঞ্জ জেলা শাখার সভাপতি খালেদ হাসান জুম্মন বলেন, “কৃষি শ্রমিকদের ন্যায্য মজুরি নিশ্চিত করতে হবে। মৌসুমি কাজ ছাড়াও কৃষিতে বিকল্প কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করতে হবে।”
কিশোরগঞ্জ জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপ-পরিচালক ড. মো. সাদিকুর রহমান জানান, চলতি বোরো মৌসুমে কিশোরগঞ্জে ৪৫ হাজার ৬০ জন কৃষিশ্রমিক কাজ করছেন, যেখানে আগে এই সংখ্যা ছিল লাখো। তবে ৫৭১টি কম্বাইন্ড হারভেস্টার মেশিন ব্যবহারের ফলে দ্রুত ধান কাটা সম্ভব হচ্ছে।
কৃষি খাতকে টিকিয়ে রাখতে হলে কৃষিশ্রমিকদের ন্যায্য মজুরি, মর্যাদা ও সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করার পাশাপাশি তরুণদের আধুনিক কৃষিতে যুক্ত করার উদ্যোগ নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।