যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যকার চলমান বাণিজ্যযুদ্ধ এক নতুন বাস্তবতার জন্ম দিয়েছে। সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সময়কালে আরোপিত অতিরিক্ত শুল্কে যেমন চীনা পণ্যের ওপর চাপ বেড়েছে, তেমনি সেই চাপ এড়াতে শুরু হয়েছে শুল্ক ফাঁকির প্রতিযোগিতা। সাম্প্রতিক সময়ে মার্কিন ব্যবসায়ী ও সরকারি কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, চীনা কোম্পানিগুলো এখন যুক্তরাষ্ট্রে পণ্য পাঠাতে নানান কৌশল প্রয়োগ করছে, যার বেশির ভাগই পড়ছে শুল্ক জালিয়াতির আওতায়।
চীনা কোম্পানির রহস্যময় প্রস্তাব
চীনের বিভিন্ন জাহাজ পরিবহন কোম্পানি মার্কিন আমদানিকারকদের কাছে ই-মেইল, টিকটকসহ বিভিন্ন মাধ্যমে প্রলোভনমূলক প্রস্তাব পাঠাচ্ছে। প্রস্তাবগুলোর ভাষ্য এমন—”উচ্চ শুল্ক এড়িয়ে চীনা পণ্য যুক্তরাষ্ট্রে পাঠানো সম্ভব”, “মাত্র ১০ শতাংশ শুল্কেই আমদানি”, কিংবা “শেষ পর্যন্ত কোনো শুল্কই দিতে হবে না”। এসব প্রস্তাব প্রতারণার একটি নতুন পর্ব বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
পুরনো ছক, নতুন রূপ: ট্রান্সশিপমেন্ট ও ভুল তথ্য উপস্থাপন
চীনা কোম্পানিগুলো শুল্ক কমাতে যে কৌশলগুলো গ্রহণ করছে, তার মধ্যে রয়েছে—
চালানের তথ্য বিকৃতি: পণ্যের প্রকৃত মূল্য কম দেখানো হয় যাতে শুল্ক কমে যায়।
ভুল শ্রেণীকরণ: উচ্চ শুল্কযুক্ত পণ্যকে কম শুল্কের আওতাধীন ক্যাটাগরিতে দেখানো।
ট্রান্সশিপমেন্ট: চীন থেকে পণ্য প্রথমে অন্য দেশে (যেমন মালয়েশিয়া, ভিয়েতনাম) পাঠানো হয়, পরে সেখান থেকে যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি করা হয়।
বিশেষজ্ঞদের মতে, এগুলো সবই শুল্ক ফাঁকি ও বাণিজ্য আইনের লঙ্ঘনের উদাহরণ।
‘ডিডিপি’ পদ্ধতি: দৃষ্টির আড়ালে পণ্যের গন্তব্য
চীনা কোম্পানিগুলো এখন ‘Delivered Duty Paid (DDP)’ নামে একটি নতুন কৌশল চালু করেছে। এতে পণ্য আমদানির পুরো প্রক্রিয়াই নিয়ন্ত্রণ করে চীনা কোম্পানি। শুল্ক পরিশোধের দায়ও তাদেরই। ফলে মার্কিন কোম্পানিগুলোর দায় কমে গেলেও পুরো প্রক্রিয়া ঘোলাটে হয়ে ওঠে। আর মার্কিন প্রশাসনের পক্ষে অপরাধীকে শনাক্ত করা হয়ে পড়ে কঠিন।
বিপাকে সৎ ব্যবসায়ীরা
শুল্ক ফাঁকির এই প্রতিযোগিতায় সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে সৎ ব্যবসায়ীরা। তারা উচ্চ হারে শুল্ক পরিশোধ করে প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়ছে। অনেক প্রতিষ্ঠানের দাবি, এসব অবৈধ কার্যক্রমে যুক্তরাষ্ট্র সরকার প্রতিবছর শত শত কোটি ডলারের রাজস্ব হারাচ্ছে। প্লুজ নামের একটি গাড়ির যন্ত্রাংশ উৎপাদনকারী কোম্পানির নির্বাহী ডেভিড রশিদ বলেন, “এই অবস্থায় যদি কিছু না করা হয়, তাহলে জালিয়াতরাই বিজয়ী হবে।”
আইনের ফাঁক আর নজরদারির দুর্বলতা
আমেরিকান আইনজীবী জন ফোটের মতে, ব্যবসায়ীরা শুল্ক ফাঁকিকে এখন নিরীহ প্রশ্ন হিসেবে নিচ্ছেন। প্রতিদিনই কেউ না কেউ জানতে চায়—“এই উপায়ে শুল্ক ফাঁকি দেওয়া যাবে কি?” মে মাসের মাঝামাঝি পর্যন্ত ফোট তাঁর অফিসের হোয়াইটবোর্ডে ১১ বার এমন প্রশ্ন শোনার দাগ টেনেছেন।
ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি?
যুক্তরাষ্ট্রে শুল্ক এড়ানোর চর্চা নতুন নয়। আমেরিকান উপনিবেশের সময় ব্রিটিশ বন্দরগুলোতে চোরাচালানের মাধ্যমে পণ্য প্রবেশ করানো হতো। তবে ট্রাম্পের সময়কার অতিরিক্ত শুল্ক, বিশেষ করে চীনা পণ্যে ১৪৫ শতাংশ পর্যন্ত শুল্ক আরোপ, শুল্ক জালিয়াতিকে এক নতুন উচ্চতায় নিয়ে গেছে।
নজরে মেক্সিকো ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া
তথ্য বিশ্লেষক সংস্থা ‘এক্সিজার’-এর তথ্য অনুযায়ী, মেক্সিকোর তিন হাজারের বেশি কোম্পানি সরাসরি চীনের ওপর নির্ভরশীল, যাদের বেশিরভাগই যুক্তরাষ্ট্রে পণ্য সরবরাহ করে। এ ছাড়া মালয়েশিয়া ও ভিয়েতনামের মতো দেশগুলোতেও চীনা পণ্যের ট্রান্সশিপমেন্ট বেড়েছে, যা মার্কিন বাণিজ্য বিধির সুস্পষ্ট লঙ্ঘন।
কী হবে সমাধান?
যুক্তরাষ্ট্রের শিল্পপতিরা কংগ্রেসের কাছে আহ্বান জানিয়েছেন, তারা যেন শুল্ক ও বাণিজ্য জালিয়াতি দমন আইনে আরও কঠোরতা আনেন, প্রযুক্তিগত নজরদারিতে বিনিয়োগ করেন এবং প্রতারকদের বিরুদ্ধে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করেন।শার্লট পাইপ অ্যান্ড ফাউন্ড্রির নির্বাহীরা পরিস্থিতিকে তুলনা করেছেন ‘হ্যাক-এ-মোল’ খেলার সঙ্গে—একটি জালিয়াতি বন্ধ করলে আরেকটি মাথা তোলে। এই অবস্থা বন্ধ করতে হলে চাই সমন্বিত উদ্যোগ, নয়তো শুল্ক যুদ্ধের এই ইঁদুর-বিড়াল খেলায় হারতে হবে সৎ ব্যবসায়ীদেরই।